সুখী মুসলিম দম্পতির ৫টি অভ্যাস!

মুসলমানদের জন্য বিয়ে কেবল একটি নতুন সম্পর্কই নয়। এটি ফরজ কাজ, এতে রয়েছে আল্লাহর রহমত, এতে রয়েছে পরম প্রশান্তি; এটি জীবনকে করে তৃপ্তিময়, পূর্ণাঙ্গ এবং চিন্তাশীল সম্প্রদায়ের জন্য এতে অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে। 

অনেকে আবার এই সুন্দর সম্পর্ক থেকে প্রশান্তি শান্তি খুঁজে পাচ্ছে না; পাচ্ছে কলহ, কাটাচ্ছে দুর্বোধ্য সময়। 

মুসলিম দম্পতিদের শীর্ষ ৫টি অভ্যাস এখানে দেয়া হলো। এগুলো সংসারে আরো প্রশান্তি এবং সুখ পেতে সাহায্য করবে বলে আমি বিশ্বাস করি। 

১. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তারা একে অপরকে ভালোবাসেন! 

আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একে অপরকে ভালোবাসার অর্থ কী? এর অর্থ- আপনি কারো সাথে আপনার সম্পর্কের ভিত্তি তৈরি এবং কেন্দ্রীভূত করেন একমাত্র আল্লাহর ভালোবাসা এবং আনুগত্যর জন্যই। কারণ আমরা আল্লাহর দাস। আপনার-আমার সবসময় সবকিছুই হওয়া উচিত আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। আর আল্লাহর বলেই দিয়েছেন যে, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক তিনি বানিয়েছেন প্রশান্তির জন্য। এই শান্তি বজায় রাখা আপনার দায়িত্ব। 

একটি সংসার ভাঙলে শয়তান খুব খুশি হয় আর আল্লাহ দুঃখ পান। আপনি যদি কারো ভুল ক্ষমা করেন এবং তার প্রশংসা করেন, আল্লাহ আপনার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। আপনার জীবনকে আরো হ্যাপি করতে আল্লাহর রহমত আপনার দরকার। নিজেদের চরিত্র, পবিত্রতা আর ব্যবহার ঠিক থাকলে কখনই কোনো সমস্যা আসবে না।

মুসলিম দাম্পত্য জীবনে সুখ আসবে, যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য একসাথে ফজরের নামাজ পড়েন। একসাথে কোরআন পড়েন এবং বোঝার চেষ্টা করেন। কোনো সমস্যা এলে নিজেদের মধ্যে কথা বলুন। আল্লাহর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করুন। তবেই দেখবেন একে অপরের মধ্যে প্রেমময় সম্পর্ক ও গভীর মায়া তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় দাম্পত্য জীবনে কেবল সুখই আসতে পারে। 

Image by pch.vector on Freepik

২. তারা একে অপরের প্রতি সবসময় কৃতজ্ঞ থাকে!

আপনি যখন নতুন বিয়ে করেন, তখন কী হয়? আপনার স্ত্রীর রান্না করা খাবার প্রতিবার খেতে খেতে ‘দারুণ হয়েছে’ বলে ধন্যবাদ দেন। এরপর বছর না ঘুরতেই আপনি ওটাকে তার কাজ বলে মেনে নেন। তাই আর ধন্যবাদ দেয়ার কথা মনে থাকে না।

স্ত্রীদের বেলাতেও একইরকম ঘটে। প্রথম দিকে আপনার কিছু প্রয়োজন হলে স্বামীকে আনতে অনুরোধ করেন এবং আনলে ধন্যবাদ দেন। কিন্তু বছর না ঘুরতেই আপনি ওটা তার দায়িত্ব বলে মেনে নেন। তাই আর অনুরোধ আর ধন্যবাদ কোনোটাই থাকে না কথার মধ্যে। 

আসলে এই ধন্যবাদ কেবল স্বামী বা স্ত্রীর জন্য নয়, আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশও। আপনি যখন ধন্যবাদ দেন, তখনই আসলে আপনি আল্লাহর কাছেও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন যে তিনি তাকে খুব ভালো রান্নার হাত দিয়েছেন। আপনার স্বামী যখন আপনার জন্য দরকারি কিছু আনে; তখন আপনার দেয়া ধন্যবাদে একইভাবে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায়। কারণ, আল্লাহই তাকে অর্থনৈতিক সামর্থ্য দিয়েছেন।

সুখী মুসলিম দম্পতিরা একে অপরের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকার জন্য এই হাদিসটি যথেষ্ট-

‘যে লোককে ধন্যবাদ দেয় না, সে আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ নয়।’ আবু দাউদ।

ভালোবেসে খুঁজে দেখুন, আপনার স্বামী বা স্ত্রীকে ধন্যবাদ দেয়ার জন্য হাজারটা কারণ পাবেন। আল্লাহ এই সম্পর্কটা এভাবেই বানিয়েছেন। কৃতজ্ঞ আপনাকে হতেই হবে। আল্লাহ কোরআনে ঘোষণা করেছেন-

‘… তোমরা কৃতজ্ঞ হলে, আমি অবশ্যই তোমাদের আরো দেব; আর যদি তোমরা অকৃতজ্ঞ হও, তবে আমার শাস্তি হবে কঠোর।’ সুরা ইবরাহিম, আয়াত : ৭।

এবার ওপরের হাদিসটি আবার পড়ুন। দেখবেন সব পরিষ্কার হয়ে গেছে। কেন দিন গড়ালে সংসারে অশান্তি শুরু হয়, বুঝতে পারছেন?

স্ত্রী হচ্ছে আমাদের ওপর আল্লাহর এক অপরিসীম অনুগ্রহ ও নেয়ামত। আধ্যাত্মিক, আবেগময়, মানসিক ও শারীরিক স্বাচ্ছন্দ্যের একটি অপরিবর্তনীয় উৎস। সুখী মুসলিম দম্পতিরা আরো সুখী হতে থাকে, কারণ তারা (উপযুক্ত আয়াতে) কেবল আল্লাহ আদেশটি কার্যকর করে। তারা একে অপরের জন্য প্রতিদিন কৃতজ্ঞ, তাই তারা একে অপরের মধ্যে যে আনন্দ পেয়েছে, আল্লাহ তা বাড়িয়ে তোলেন, যেমন তিনি ওয়াদা করেছেন।

আয়াতটির শেষ অর্ধাংশ প্রতিটি বিবাহিত ব্যক্তির ভালো করে মনে রাখা উচিত, ‘… যদি আপনি অস্বীকার করেন, তবে অবশ্যই আমার শাস্তি কঠোর।’

ইগো ভুলে আজই স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে সরি এবং থ্যাংক ইউ বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন। দেখবেন দাম্পত্য জীবন আরো সুন্দর হয়ে উঠেছে।

৩. তারা একে অপরের প্রাথমিক প্রয়োজনগুলোর প্রতি মনোযোগী

আমার করা ছোট রিসার্চ থেকে বলতে পারি, দাম্পত্য কলহের প্রথম সূত্রপাত হয় একে অপরের প্রাথমিক চাহিদার প্রতি অমনোযোগিতা থেকে। এরপর ধীরে ধীরে শুরু হয় বড় কিছুর থেকে। 

স্বমী-স্ত্রীর প্রাথমিক চাহিদাগুলো জানতে চাইলে, অল্প কিছু বই পড়লেই আপনি জানতে পারবেন। এটা কঠিন কাজ নয়। পুরুষ এবং মহিলা উভয়েরই ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, শারীরিক ও মানসিক তৃপ্তি এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা থাকে। ব্যক্তিভেদে দুয়েকটি চাহিদা যুক্ত হবে। নারী এবং পুরুষের মানসিক কারণে তাদের অনুভূতি ও অনুভূতির প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন হয়। এ ব্যাপারে আপনার কিছুটা পড়াশোনা করাই উচিত। তবে একটি ব্যাপার অবশ্যই মনে রাখতে হবে, মনে ভালোবাসা না থাকলে কেবল শরীর আপনাকে তৃপ্তি দিতে পারবে না।

আপনার স্ত্রীর প্রাথমিক প্রয়োজনীয়তাগুলো কীভাবে নির্ধারণ করবেন?

স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করুন, আপনার বেশিরভাগ আচরণ তার পছন্দ হয় কি না? আপনার কোনটা তার খারাপ লাগে, কোনটা ভালো লাগে? কখন তিনি একা থাকতে পছন্দ করেন? আপনার সারা মাসের আর্থিক পরিকল্পনার কথা শেয়ার করুন? ঘরে শান্তিময় এবং ইসলামিক পরিবেশ বজায় রাখতে কী করা যায় চিন্তা করুন। 

ঘরের যেকোনো কাজে স্ত্রীর সাথে পরামর্শ করুন। স্ত্রীকে উপহার দিন, প্রশংসা করুন, একসাথে নামাজ পড়ুন এবং কোরআন তেলাওয়াত করুন।

এরপর স্ত্রীর চাহিদা পূরণের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করুন। আল্লাহর সাহায্য কামনা করুন। একমাত্র তিনিই পারেন আপনাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করতে। আর কেউ পারেন কি?

৪. তারা প্রকৃত শত্রুদের সাথে লড়াই করে : অহংকার, ইগো ও শয়তান

অহংকার : শান্তিময় জীবন ধ্বংস করার জন্য অহংকারই যথেষ্ট। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কে বেশি বড় এইসব অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লাখ লাখ সংসার ভেঙে যাচ্ছে। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আসলে কি কেউ বড়? মুসলিম দম্পতিদের চিন্তায় এসব আসার কথা নয়।

অহংকার হলো আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি গোপন শত্রু। অহংকার একটি বিবাহের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি; কারণ এটি ভেতরের শত্রু। অহংকার একটি প্রতারণামূলক দ্বৈত এজেন্টের মতো, যা বাস্তবকে বিকৃত করে। আসল সত্যাটি নবীজী (স.) বলেছেন-

‘একজন বিশ্বাসী তার ভাইয়ের আয়নাস্বরূপ। যখন সে এতে কোনো ত্রুটি দেখবে, তখন তার উচিত এটি সংশোধন করা।’ আল আদাব আল মুফরাদ।

তাই স্বামী বা স্ত্রী একজন অন্যজনের মধ্যে খারাপ কিছু দেখলে প্রথমে নিজেকে ঠিক করে নেয়া উচিত। তবেই দেখবেন ভেতরে অহংকার থাকবে না।

ইগো : অনেক সময় স্বামী বা স্ত্রীর মধ্যে দেখা যায় এমন কথা বলতে, ‘আমি বলেছি তাই এটাই ঠিক, এটাই শেষ কথা, এটাই করতে হবে, আমি ঠিক।’ এইসব বাক্য যখন বলবেন, তখন অবশ্যই পরীক্ষা করে দেখুনÑ ইগো থেকে বলছেন না তো?

শয়তান : নবীজী (স.) বলেছেন,

‘ইবলিস (শয়তান) তার সিংহাসন জলের ওপরে রাখে; তারপরে সে বিচ্ছিন্নতা (বিতর্ক সৃষ্টি করার জন্য) প্রেরণ করে; পদমর্যাদার কাছে তার নিকটতম হলো তারা, যারা মতবিরোধ তৈরিতে সবচেয়ে বেশি কুখ্যাত। তাদের একজন এসে বলে, আমি তাই করেছি এবং তাই করছি। এবং সে বলেছে, তুমি কিছুই করোনি। অতঃপর তাদের মধ্যে একজন এসে বলে, আমি স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বিভেদের বীজ বপন না করা পর্যন্ত আমি তা ছাড়িনি। শয়তান তার কাছে গিয়ে বলে, ‘তুমি ভালো করেছ এবং তারপরে তাকে জড়িয়ে ধরে।’ মুসলিম।

শয়তান একজন মুসলমান দম্পতির সংসার ভাঙতে পারলে খুব খুশি হয় আর আল্লাহ খুব কষ্ট পান। তাই বিবাহিত জীবনে শয়তানের ধোঁকা থেকে সাবধানে থাকুন। শয়তান আপনার প্রকাশ্য শত্রু।

৫. তারা কখনই ঝগড়া করে আলাদা বিছানায় ঘুমায় না 

ঝগড়া করে কখনই আলাদা বিছানায় ঘুমাবেন না। এতে মনের দূরত্ব আরো বাড়ে। তাই যত ঝগড়াই হোক, ঘুমানোর আগেই সব মিটিয়ে ফেলুন। আমার জীবনসাথীর (আমার কাছে ‘স্ত্রী’র চাইতে ‘জীবনসাথী’ শব্দটা খুব পারফেক্ট মনে হয়) সঙ্গে ঝগড়া হলে আমি তার জন্য খুব দোয়া করি। দোয়া করতে করতে আমার রাগ কমে যায়, আমার দোয়ার প্রভাবে তার রাগও কমে যায়। আমরা সবসময় এক বিছানায় ঘুমাই। রাগারাগি হলে অবশ্যই এক বিছানায় ঘুমাই এবং আরো কিছু করি…! রাগ-দুঃখ-শোক কমাতে এটা আল্লাহর দারুণ একটা নেয়ামত। এর জন্য আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *